সম্মেলনের বাকি কয়েক সপ্তাহ। তবু বিতর্ক থামছে না ছাত্রলীগকে ঘিরে। যাচাই-বাছাই ছাড়া ঘোষণা করা হচ্ছে বিভিন্ন শাখা কমিটি। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অছাত্র, শিক্ষক নির্যাতনকারী, আজীবন বহিষ্কৃত—এমনকি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িতদেরও নেতা বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। তাদের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ কর্মীরা বলছেন, শেষ মুহূর্তের ‘বাণিজ্যে’ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন শীর্ষ দুই নেতা।
কেন্দ্রীয়
নেতৃত্বের এসব সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ
করে বিভিন্ন জেলায় চলছে বিক্ষোভ
ও অগ্নিসংযোগ। সংবাদ
সম্মেলন করছেন বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তারপরও
টনক নড়ছে না ছাত্রলীগের
দুই কাণ্ডারির।
সর্বশেষ
সোমবার রাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির
মাধ্যমে অন্তত ছয়টি শাখার
কমিটি দিয়েছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা। কমিটি
ঘোষণার পরই শুরু হয়
বিতর্ক। রাজাকার
ও বিএনপি পরিবারের সদস্য
এবং শিক্ষককে প্রহারের দায়ে ছাত্রলীগ থেকে
আজীবন বহিষ্কৃতদের মোটা অঙ্কের বিনিময়ে
কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক
করা হয়েছে বলে অভিযোগ
ছাত্রলীগের একাধিক নেতার।
পরীক্ষায়
অকৃতকার্য হওয়ায় পাবনা বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাঙচুর চালান শাখা
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মিজানুর
রহমান সবুজ। তাকে
আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছিল
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এবার
পাবনা জেলার সভাপতি হয়েছেন
তিনি। একই
বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. নুরুল্লাহ নামের
একজনকে করা হয়েছে সাধারণ
সম্পাদক। তিনি
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এক ব্যক্তির নাতি
বলে জানিয়েছেন পাবনা জেলা আওয়ামী
লীগের একাধিক নেতা।
নুরুল্লাহর দাদা মহিরুদ্দিন মকাই
মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর ছিলেন এবং
মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুস
সোবহানের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন বলে
জানা গেছে। বিষয়টি
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে জানানোর পরও পদ দেওয়া
হয় নুরুল্লাহকে।
এ
বিষয়ে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের
সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আ স ম
আব্দুর রহিম পাকন বলেন,
তার (নুরুল্লাহ) দাদা রাজাকার ছিল। আমাকে
একটি সংস্থার লোকেরা বিষয়টি জানানোর
পর নিজেও খোঁজ নিয়েছি।
এ
ছাড়া বগুড়া জেলা কমিটিতে
বিতর্কিতদের স্থান দেওয়ার কারণে
সদ্য ঘোষিত কমিটি বাতিলের
দাবিতে বিক্ষোভ করছেন জেলা ছাত্রলীগের
একাংশের নেতাকর্মীরা। কমিটি
ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই
পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর
ঘোষণা দিয়েছেন তিন নেতা।
বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনে
কমিটি করা হয়েছে বলে
অভিযোগ তাদের।
এদিকে,
পিরোজপুর জেলা কমিটি নিয়েও
শুরু হয়েছে বিতর্ক।
অছাত্র ও মাদকাসক্তদের পদায়নে
ক্ষুব্ধ সাবেক ও বর্তমান
নেতারা। আজ
বুধবার সকালে তারা জাতীয়
প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন
করবেন বলে জানা গেছে।
সংগঠন
সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ
ছাত্রলীগের ৩০তম সম্মেলন ঘোষণার
পরই কমিটি করতে তোড়জোড়
শুরু করেন ছাত্রলীগ সভাপতি
জয় ও সাধারণ সম্পাদক
লেখক। গত
আগস্টের পর এ দুই
নেতা হাতেগোনা কয়েকটি ইউনিটের কমিটি
দিলেও সম্মেলনের আগে সব জেলায়ই
কমিটি করতে চান।
দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি
দাবি করেন, এখন পর্যন্ত
৬১টি ইউনিটের কমিটি দেওয়া হয়েছে। বাকি
আছে ৫৮টি জেলা।
নেতাকর্মীরা
জানান, শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো
করে সম্মেলন ছাড়া শুধু বিজ্ঞপ্তি
দিয়ে কমিটি করা হচ্ছে। আর্থিক
সুবিধা আদায় করাই এসব
কমিটির লক্ষ্য। এর
আগে তারা যেসব কমিটি
ঘোষণা করেছেন, সেগুলো নিয়েও বিতর্ক
অনেক। আগেও
মাদকাসক্ত থেকে শুরু করে
হত্যা মামলার আসামি এবং
বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সদস্য ও বিতর্কিতদের
নেতা বানানো হয়েছে।
জানা
গেছে, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে স্থগিত করা
হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি। তবে
সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পর
স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া হয়। ইডেন
মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের দুই
পক্ষের রেষারেষি ও সিট বাণিজ্যের
ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর
কমিটি স্থগিত করা হয়। তবে
সম্মেলনের আগেই এই স্থগিতাদেশ
তুলে নেওয়া হবে বলে
গুঞ্জন উঠেছে। নৈতিক
স্খলনের দায়ে রাজশাহী জেলা
ছাত্রলীগের সভাপতি সাকিবুল ইসলাম
রানা ও সাধারণ সম্পাদক
জাকির হোসেন অমিকে ছাত্রলীগ
থেকে বহিষ্কার করে কমিটি বিলুপ্ত
ঘোষণা করা হয়েছে।
যশোরের মণিরামপুরে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে বিতর্কিতদের
নেতা বানানো হয়েছে—এমন
অভিযোগে লেখককে নিজ এলাকায়
অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতিকে মাদকের অভিযোগে বহিষ্কার
করার পর আরেক মাদক
ব্যবসায়ীকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে পদায়ন করা
হয়। নেত্রকোনায়
মাদক ও হত্যা মামলার
আসামিকে বানানো হয় সাধারণ
সম্পাদক। হবিগঞ্জে
জাতীয় পরিচয়পত্র বদলে আরিফ বাপ্পিকে
নেতা বানানোর অভিযোগ আছে।
বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের কমিটিকে
অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে খোদ
জেলা আওয়ামী লীগ।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি একবার বিলুপ্ত
ঘোষণার পর ফের বহাল
করা হয়। সিলেটে
কমিটি করার পর জয়-লেখকের বিরুদ্ধে ১
কোটি ২০ লাখ টাকা
বিনিময়ের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ
করেন ছাত্রলীগের এক নেতা।
এ
বিষয়ে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কামাল খান বলেন,
শেষ দিকের বেশিরভাগ কমিটিই
বিতর্কিত। প্রতিটি
কমিটি প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।
কেন্দ্রীয়
ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সোহান খান বলেন,
সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পর
কমিটি করার যেহেতু কর্তৃত্ব
থাকে না, তাই এখন
নিজেদের স্বার্থের জন্য কমিটি দেবে
তারা। এটা
ছাত্রসমাজ হতে দেবে না।
ছাত্রলীগ
নেতা কামাল হোসেন বলেন,
এর আগেও তাদের বিরুদ্ধে
কমিটি কেন্দ্রিক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ
উঠেছিল। তারা
সেটা খণ্ডন করতে পারেননি। এ
অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ
নেই।
ছাত্রলীগ
সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮
সালের ১১ ও ১২
মে ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলনে সভাপতি
রেজোয়ানুল হক চৌধুরী শোভন
ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম
রাব্বানী নির্বাচিত হন; কিন্তু চাঁদাবাজিসহ
নানা অভিযোগে এক বছর পেরোতেই
তাদের পদচ্যুত করা হয়।
এরপর ২০১৯ সালের ১৪
সেপ্টেম্বর সংগঠনের দায়িত্ব পান আল-নাহিয়ান
খান জয় ও লেখক
ভট্টাচার্য।
নেতাকর্মীদের
অভিযোগ, গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে একক
সিদ্ধান্তে সম্মেলন না করে বিজ্ঞপ্তির
মাধ্যমে কমিটি দিয়েছেন জয়
ও লেখক। গঠনতন্ত্রে
দুই মাস অন্তর কেন্দ্রীয়
কার্যনির্বাহী কমিটির সভা করার
কথা থাকলেও গত তিন
বছরে তারা করেননি একটিও। সর্বশেষ
আগস্টের এক দিন আগে
নিয়মের তোয়াক্কা না করে কমিটি
বর্ধিত করেছেন ওই দুই
নেতা। সেখানে
ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে শুধু
চিঠি দিয়ে পদায়ন করা
হয়েছে। তাদের
অনেকের বিরুদ্ধে শিবির-ছাত্রদল করা,
ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি, ছাত্র নির্যানতকারী, মাদকাসক্তসহ
বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে।
বর্ধিত কমিটিতে কাদের পদায়ন করা
হয়েছে, সে তালিকাও প্রকাশ
করেননি তারা।
এ
বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ সভাপতি
আল-নাহিয়ান খান জয় ও
সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার
মোবাইল ফোনে কল দেওয়া
হলেও তারা রিসিভ করেননি।
সুত্র:
কালবেলা